কাশ্মীরের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে ফিরল নিথর দেহ

কলকাতা, ২৪ এপ্রিল: কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় প্রাণ হারানো দুই বাঙালির নিথর দেহ বুধবার সন্ধ্যায় ফিরল কলকাতায়—একটি নিছক দেহবাহী বিমান নয়, যেন শোক বহনকারী আকাশযান।নিহতদের মধ্যে একজন, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের কর্মী সমীর গুহ। আরেকজন, আমেরিকা নিবাসী বিতান অধিকারী, যিনি ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিলেন। কাশ্মীরে ঘুরতে গিয়ে আচমকা এক আতঙ্কবাদী হামলার শিকার হন তাঁরা।বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ২৯ মিনিটে দিল্লি হয়ে কলকাতার বিমানবন্দরে নামেন তাঁরা। আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল বিমানবন্দরের পাঁচ নম্বর কার্গো গেট। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পুলিশি প্রহরা আর গার্ডরেলের ভিড়ে ঢেকে গিয়েছিল গোটা এলাকা। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সরকারের মন্ত্রী, পুর প্রতিনিধিরা, এমনকি মেয়র ফিরহাদ হাকিমও।বিমান নামার ঠিক ৩৭ মিনিট পরে, সন্ধ্যা ৮টা ৬ মিনিটে কার্গো গেট দিয়ে বেরোয় সমীরের দেহ। তাঁর স্ত্রী শর্বরী গুহ, কন্যা শুভাঙ্গী এবং আত্মীয়দের চোখে তখন শুধু বেদনার জল। শোকস্তব্ধ মুখে তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন শেষ দেখা পাওয়ার জন্য। ঠিক রাত ৯টা ১০ মিনিটে বাড়ি ফেরেন সমীর গুহ—তবে জীবন্ত নয়, কাঠের কফিনে।সমীর ছিলেন পাড়ার এক পরিচিত মুখ, স্থানীয় ক্লাবের অন্যতম প্রাণ। সেই ক্লাবেরই পুজো মণ্ডপে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করা হয়। প্রতিবেশী থেকে রাজনীতিবিদ—তৃণমূলের মালা রায় ও বিজেপির ইন্দ্রনীল খাঁ সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। হাতে সাদা মালা, চোখে জল।ক্লাবের সদস্য বাবু চট্টোপাধ্যায়ের গলা ভারী হয়ে উঠেছিল, “চাঁদা তোলা হোক বা খেলাধুলোর আয়োজন—সমীরদা সব সময় পাশে থাকতেন।” প্রতিবেশী শম্পা মিত্রও বলেন, “অসাধারণ মানুষ। কারও বিপদে ছুটে আসতেন চুপিচুপি।”দেহ পৌঁছানোর পরে সহকর্মীরাও তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। রজত সেন নামের এক সহকর্মী বলেন, “তিনি শুধু অফিসের ভালো সহকর্মী নন, মানসিকভাবে একজন ভরসা ছিলে।”সমীরের মেয়ে শুভাঙ্গী, সদ্য দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়া এক কিশোরী, বাবার কফিনের পাশে পাথরের মতো নিস্তব্ধ। কান্নাও যেন তাঁকে ছেড়ে গেছে। সমীরের স্ত্রী শর্বরী গুহ কফিনের সামনে ভেঙে পড়েছেন কান্নায়, আর তিন বছর বয়সী হৃদান একটাই কথা বলে চলেছে, “ওই তো বাবা শুয়ে আছেন। বলেছিলেন আমাদের নিয়ে যাবেন। কিন্তু এখন কে নিয়ে যাবে?”এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই।”একটি ছোট্ট ছেলের চোখে বাবা থাকার শেষ স্মৃতি হয়ে থাকল সেই কাঠের বাক্সটা।

রাত ৯টা ৪২ মিনিটে শববাহী গাড়ি যখন কেওড়াতলার দিকে রওনা দেয়, তখন পাড়ার মানুষ একে একে পথঘাটে দাঁড়িয়ে তাঁকে শেষ বিদায় জানান। রাত ১০টার কিছু পরে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।এদিকে বিতান অধিকারীর দেহ পৌঁছায় রূপকথা আবাসনের সামনে। তার অল্প সময় পরেই তা তোলা হয় দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চোখের জলে ভিজে ওঠে ঘর।তবে বিতানের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিল নীরব অথচ মর্মস্পর্শী। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে এক ঝলক স্বামীর দেহের দিকে তাকান, কিন্তু পেছনে রাখা খাঁচাবন্দি দু’টি ককটেল পাখির দিকে চোখ পড়তেই গলার স্বর জড়িয়ে আসে—”ওই দুটো পাখি ছেলেকে কিনে দিতে বলেছিলে। ওরা থেকে গেল, তুমি চলে গেলে।”রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ কেওড়াতলায় একসঙ্গে শেষ বিদায় জানানো হয় সমীর ও বিতানকে।এ এক রাত, যা কলকাতা ভুলবে না। দু’টি পরিবার, এক শহর, আর অগণিত মানুষের চোখের জল—সব মিলিয়ে এক অবিস্মরণীয় বিদায়ের ছবি।

ঘটনাটি গোটা শহরকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একদিকে রাষ্ট্রীয় স্তরের নিরাপত্তা প্রশ্নে উদ্বেগ, অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনের চিরতরে বদলে যাওয়া মুহূর্ত। একটি ছেলের বাবাহারা হয়ে যাওয়া, একটি স্ত্রীর সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণা—এই সবকিছু মিলে এক তীব্র বাস্তব।এই ট্র্যাজেডি কেবল দুইটি পরিবারের নয়, বাংলার বুকেও রেখে গেল গভীর ক্ষতচিহ্ন।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More posts